Thursday, 6 February 2014

মুসলিম মিল্লাতের মহান জাতীয় শহীদ দিবস শাহাদাতে কারবালা দিবস

মূল প্রবন্ধঃ ইমাম হায়াত আলাইহে রাহমা
সংকলনেঃ অধ্যাপক আল্লামা ডঃ কাওছারুল আমীন রাছেখ
(প্রাক্তন অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ)
ইসলামি গবেষক ও কেন্দ্রীয় নেতা, ছুন্নী আন্দোলন, বাংলাদেশ
(World Sunni Movement)

ইসলাম ঈমানের মাধ্যমে মানুষকে সব বস্তুর উর্ধে সব সৃষ্টির উর্ধে একটা সত্ত্বা ও পরিচয়, জীবন ও জীবনের রূপরেখা দিয়েছে। সব মানুষের জন্য এটা মানবিক সত্ত্বা বা ইনছানিয়াত আর ঈমান গ্রহণকারীর জন্য এটা তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক সত্ত্বা বা মুমিন সত্ত্বা, যার ভিত্তি ঈমানের পবিত্র কলেমা। পবিত্র কলেমা গ্রহণের মাধ্যমে এবং কলেমার বিপরীত বস্তুবাদী সত্ত্বার প্রত্যাখানের মাধ্যমে এটা ঘোষিত ও নির্ধারিত হয়। তাই মুমিনের আত্মসত্ত্বা ও পরিচয়, জীবন ও জীবনের রূপরেখা কোন বস্তুর ভিত্তিতে নয়, একমাত্র আল্লাহর নামে রেছালাতে ইলাহীকে অর্থাৎ রাছুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়। মুমিন তাই কোন বস্তুর দাস নয়, বস্তুপূজারী নয়, বস্তু মানুষের জন্য, মানুষ বস্তুর জন্য নয়, বস্তু মানুষের কল্যাণের জন্য, ব্যবহারের জন্য, কিন্তু মানুষের উর্ধে নয়।

রেছালাতই তাওহীদের প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং রেছালাত কেন্দ্রিকতা, রেছালাতের সম্পর্ক ও অবলম্বনের মাধ্যমে রেছালাত ভিত্তিক হওয়ার মাধ্যমেই আত্মা ও জীবন তাওহীদভিত্তিক হয়। বস্তুর ভিত্তিতে মূল আত্মপরিচয় আত্মসত্ত্বা নির্ধারন বস্তুকে মানবসত্ত্বার উর্ধে স্থান দিয়ে মনুষত্যের অপমান করা হয় এবং মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে যায়, প্রকারন্তরে মানব সত্ত্বাকে আত্মিক হত্যা করা হয় এবং মানুষকে বস্তুর দাস বানিয়ে ফেলা হয়। আত্মা ও জীবন তাওহীদ রেছালাতের পরিবর্তে বস্তুভিত্তিক হয়ে যাওয়ায় তাওহীদ রেছালাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তথা সত্যের সংযোগ হারিয়ে আঁধার বিনাশে নিপতিত হয়। এ বস্তুভিত্তিক বস্তুবাদী হওয়াটাই দ্বীনী পরিভাষায় শিরক ও কূফর। এই বস্তুবাদী জীবন চেতনার উৎস মূলতঃ নাস্তিকতা। যারা আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করে রেছালাতে অস্বীকার করে তাদের কোন না কোন বস্তুভিত্তিক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কোন না কোন বস্তুর ভিত্তিতে তাদের আত্মপরিচয় জীবন চেতনা নির্ধারন করে সেটাকেই জীবন জাতীয়তার মূল মনে করে বস্তুর দাসত্ত্বে মানসিক বন্ধী ও আত্মিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তাওহীদভিত্তিক জীবন চেতনার কেন্দ্র ও অবলম্বন যেমন রেছালাত, তেমনি নাস্তিক্যবাদী জীবনচেতনার ধারক ও অবলম্বন বস্তুবাদ, বস্তুবাদী মতবাদ।

নাস্তিক্য থেকে উদ্ভূত এই বস্তুবাদ ভাষা, গোত্র, লিংগ, বর্ণ, অঞ্চল, রাষ্ট্র প্রভৃতি বস্তুগত বিষয়কে মূল বা ভিত্তি করে তাদের দর্শন, জীবন জাতীয়তা, মূল পরিচয়, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব নির্ধারন করে মানবসত্ত্বাকে কলূষিত ও মানবতাকে ধ্বংস করে। একদিকে আত্মিক বিনাশ অন্যদিকে বস্তুর ভিত্তিতে সম্প্রদায়িকতা বিদ্বেষ হিংসা হানাহানি বৈষম্যে মানবতা বিভক্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়ে, অনিবার্যভাবে শোষণ জুলুম বিপর্যয় তৈরি হয়। নাস্তিক্যউদ্ভূত এ বস্তুবাদী জীবনচেতনা আর ঈমানের কলেমার তাওহীদ রেছালাতভিত্তিক জীবনচেতনা আলো আঁধারের মত সম্পূর্ণ বিপরীত পরস্পর বিরোধী চির সংঘাতময় বিষয়। তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক জীবন চেতনায় মানুষকে বস্তুর দাস বানানো সম্ভব নয়, মানুষের স্বাধীনতা অধিকার হরণ কিম্বা কোন জবরদস্তি সম্ভব নয়।

বস্তুবাদের এক জঘন্য শাখা আইয়ামে জাহেলিয়াতের এক বীভৎস অনাচার গোত্রবাদ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গোত্রবাদী বর্বরতা চাপিয়ে ক্ষমতা গোত্রের কুক্ষিগত করা, মানুষকে বিশেষ গোত্রের দাস বানিয়ে গোত্রবাদী রাজতন্ত্র কায়েম করা শুধু কলেমার ঈমানী দ্বীনী মূলনীতির বিপরীত নয়, শুধু মানুষের স্বাধীনতা অধিকার হরণ নয়, চরম অপরাধ ও দস্যুতা। কলেমার পরিপন্থী এসব শিরক কূফর জুলুমকে কোরআন সম্মত বলে চালিয়ে দেয়া কোরআনের মর্মই অস্বীকার। পবিত্র কলেমার উচ্চারণের মাধ্যমে মানুষের উপর আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুল ব্যতীত অন্য সব ইচ্ছাবিরুদ্ধ অন্যায্য কর্তৃত্ত্ব মালিকানা প্রত্যাখান করা হয়, মানুষের নিজের জীবনের উপর নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয় এবং মানবসত্ত্বার স্বাধীনতা ঘোষিত হয়, সকল ন্যয্য অধিকার, অলংঘনীয় মর্যাদা ও বৈধ ইচ্ছার মূল্য ঘোষিত হয়, অবারিত বিকাশ ও গতির ঘোষণা করা হয়। বস্তুভিত্তিক ভেদাভেধ বৈষম্য অবমাননা ও অবিচার রহিত হয়। পবিত্র কলেমার ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ বস্তুর দাসত্ব অতিক্রম করে নিছক জীবসত্ত্বামূলক মানবসত্ত্বারও উর্ধে চলে যায় যার নাম মুমিন সত্ত্বা। এ জন্য মুমিনের আত্মসত্ত্বা ও মূল পরিচয় ভাষা লিংগ গোত্র দেশ রাষ্ট্র পেশা বর্ণ ইত্যাদি বস্তুর ভিত্তিতে নয়, প্রথমত মানুষ হিসেবে এবং চুড়ান্তভাবে তাওহীদ রেছালাতভিত্তিক জীবন তথা সত্যভিত্তিক মানুষ বা মুমিন হিসেবে, এটা মৌলিক আত্মপরিচয় এবং মৌলিক অস্তিত্ত্ব, এর লংঘন বা বিপরীত হলে ঈমানী সত্ত্বা আর থাকে না, কলেমার উচ্চারণ অর্থহীন শাব্দিক ব্যপার হয়ে প্রতারণা প্রহসন হয়ে দাঁড়ায় নিজ জীবনের সাথে।

কলেমার ভিত্তিতে জীবনের যে রূপরেখা তাই দ্বীন বা ইসলাম। এ রূপরেখায় ইসলামের নামে বা বেনামে কোনভাবেই বস্তুবাদী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা যায় না যাবে না। দ্বীনের নামে বেনামে কোনভাবেই কলেমার দেয়া স্বাধীনতা অধিকার হরণ করা যাবে না। কোন মানুষের উপরেই তার ইচ্ছা বিশ্বাস আদর্শের বিপরীত কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এ রূপরেখায় রাষ্ট্রব্যবস্থার নাম খেলাফত বা প্রতিনিধিত্ত্ব। জনগনের প্রতিনিধি মাত্র, মালিক নন। রাষ্ট্রিয় খেলাফত আল্লাহর প্রতিনিধি নয়, মানুষের প্রতিনিধিত্ত্ব, মানুষ কর্তৃক মনোনীত বা নির্বাচিত হতে হয়, মানুষের নিকট জবাবদিহী করতে হয়। আল্লাহর প্রতিনিধি কেবল নবীগণ, আর কেউ নন। কোন মানুষ নিজেকে সরাসরি আল্লাহর প্রতিনিধি বলা মূর্খতা ও শয়তানী। এ দাবীর মধ্যে অন্যদের উপর প্রভূত্ত্ব কায়েমের ফেরাউনী অসৎ প্রবৃত্তি লুকায়িত থাকে। খেলাফত তাই দ্বীনী মূল্যবোধের ভিত্তিতে ব্যক্তিনিরপেক্ষ সর্বজনীন গণতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা। যেখানে নাগরিক হিসেবে বিশ্বাস আদর্শ নির্বিশেষে সবাই সমান। বস্তুর ভিত্তিতে কারো উপর কারো প্রাধান্য নেই। বস্তুগত কারনে কেউ উচ্চ নীচ উত্তম অধম নয়। প্রাধান্য কেবল জ্ঞান অবদান ও গুণাবলীর ভিত্তিতেই হতে পারে।

ঈমানের মূল বিষয়, পবিত্র কলেমার অঙ্গীকার,সত্য ভিত্তিক সত্ত্বা ও অস্তিত্ত্বের মূল কথা, আত্মার মুক্তি ও জীবনের আলো, এই তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক আত্মসত্ত্বাই মুমিনের অস্তিত্ত্ব। এর বিপরীতে নাস্তিক্য থেকে আসা বস্তুবাদ ও বস্তুবাদী স্বৈরাচার বস্তুবাদী দস্যুতন্ত্র মুমিন কোন অবস্থাতেই কবুল বা স্বীকৃতি কিংবা মেনে নেয়ার প্রশ্ন আসে না। বস্তুবাদী স্বৈরতন্ত্র শুধু ঈমানের কলেমার মূল বিষয়ের বিপরীত নয় বরং ঈমান দ্বীনের দেয়া সত্য, স্বাধীনতা, মানবতা, অধিকার, প্রগতি ও বিকাশের ধারাকে রুদ্ধ হরণ ও উৎখাতের জন্যই করা হয়।

মুমিন কলেমার অঙ্গীকার ও ঈমান দ্বীনের নীতিমালার বিপরীত কিছু যেমন কবুল করতে স্বীকৃতি দিতে মেনে নিতে পারে না, তেমনি অন্যের উপরও তার বিপরীত মতপথ চাপিয়ে দিতে পারে না। এজন্য কলেমার শিক্ষার ভিত্তিতে ঈমান দ্বীনের নীতির ভিত্তিতে সারা দুনিয়ার নিরপরাধ সব মানুষই স্বাধীন। জীবনের এই স্বাধীনতাই তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক জীবন চেতনার আলোকে কলেমার অন্যতম মৌলিক অলংঘনীয় শিক্ষা যার ব্যতিক্রম হলে ফেরাউনীই কায়েম হয়, প্রবৃত্তির প্রভূত্ত্ব কায়েম হয়, মানুষ মানুষের বা বস্তুর দাস হয়ে যেতে হয়, সত্য নির্বাপিত হয়। এ জন্য ইসলামের আদর্শ ও দিকদর্শনে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্বব্যবস্থা তা সার্বজনীন
মানবতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিমূলক। কোন প্রকার বস্তুবাদী স্বৈরতামূলক যেমন নয় তেমনি কেবল কোন একক ধর্ম বা শ্রেণী ভিত্তিক নয়, সার্বজনীন। এ দিকদর্শনে রাষ্ট্র ও সরকার সব ধর্ম মত পথের মূল্যবোধকে মর্যাদা দিবে, সব ধর্ম মত পথের মানুষের প্রতি নিরপেক্ষ সমান বৈষম্যহীন আচরণ ও দায়িত্ত্ব পালন করবে, কোন পক্ষপাতিত্ত্ব করবে না। রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমে কোন ধর্ম বা মতবাদ জবরদস্তি প্রতিষ্ঠা বা উৎখাত করবে না। এটা দ্বীন ও খেলাফতের অলংঘনীয় ব্যক্তিনিরপেক্ষ মূলনীতি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা নাস্তিকতা মাত্র। ব্যক্তিগতভাবে মুমিন অন্য কারো ক্ষতি না করে অবশ্যই নিজ ধর্মের পক্ষে থাকবে। কিন্তু মানুষ হিসেবে সবার কল্যাণ করবে, এটাই দ্বীনের শিক্ষা ও আদর্শ। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে কেবল রাষ্ট্রের সদস্য নাগরিক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে সবাই বিবেচিত হবে। ধর্ম বা মত পথের ভিত্তিতে কোন মতেই নয়। ব্যক্তিগত গৃহ, ধর্মীয় স্থান ও কবরস্থান ব্যতীত রাষ্ট্র ও বিশ্বের কোন অংশই কেবল একক কোন ধর্ম, এক ভাষাভাষী, একক মতবাদ বা কোন গোত্রের জন্য নির্ধারিত করে কোন একক শ্রেনীর নামে উৎসর্গ করে অন্যদের নিষিদ্ধ অস্বীকার ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার বিপরীত।

জীবনের জন্যই ইসলাম, যার প্রধান বিষয় আত্মাকে সত্যভিত্তিক তথা তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক করে বস্তুর দাসত্ব থেকে আত্মিক স্বাধীনতা আনায়ন, এর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সৎ গুনাবলী অর্জন ও অসৎ স্বভাব সমূহ থেকে মুক্তির সাধনা, নিজের ও নিজের আপনদের এবং সমগ্র মানবতার কল্যাণ সাধনের প্রয়াস, জ্ঞান বিজ্ঞান উন্নয়ন সমৃদ্ধির সাধনা এবং সব অপশক্তি থেকে নিজের এবং সবার সুরক্ষার সাধনা, এরপর বিভিন্ন এবাদত আমলের মাধ্যমে আত্মিক উন্নয়ন এবং হালাল হারামের বিষয়ে সতর্কতার মাধ্যমে জীবনের পবিত্রতা রক্ষণ। আর সবকিছুর মূল বিষয় আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের প্রেম ও নৈকট্যের সাধনা এবং সে প্রেমে নিজের এবং সবার প্রতি সমগ্র সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ উপলব্ধি। সত্য ও মানবতার সুরক্ষায় মিথ্যা ও জুলুমের উত্থান থেকে কবল থেকে মুক্তির জন্য নিরাপত্তার জন্য ঐক্য ও সার্বিক শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন অবশ্যই অপরিহার্য্য, না হয় মিথ্যা জুলুম বর্বরতার ধারক অপশক্তি শান্তি নিরাপত্তা ও মানবতা বিধবংস করে দিবে, তাই ইসলাম অরাজনৈতিক গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকে অপশক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সভ্যতা মানবতা অধিকার বিরূদ্ধ অপশক্তির সহযোগী হতে বলে না। কিন্তু সেটা দ্বীনকে নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে নয়, কেবল মানবতার জন্য। তা ও অবশ্যই ধর্ম আদর্শ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য সার্বজনীন মানবিক ও দ্বীনী মূল্যবোধ ভিত্তিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিমূলক। সেটা ধর্মরাষ্ট্রের নামে সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা নয়, মানুষের ব্যক্তি জীবনে অবৈধ হস্তক্ষেপ কিম্বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশি দায়িত্বে শরিয়তের চাপিয়ে দেয়ার জন্য নয়। দ্বীনে জবরদস্তি নিষিদ্ধ। শরিয়ত সবার কাছে এক নয়। ব্যক্তি জীবনে শরিয়ত পালন জ্ঞানের আলোকে হৃদয়ের উপলব্ধি ও আন্তরিক স্বতস্ফূর্ত পালনের বিষয়। ব্যক্তিজীবনে শরিয়ত রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব মনে করা বিকৃত চিন্তা ও দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ দুনিয়ায় মানুষের জন্য কল্যাণকর কিন্তু শরিয়তের সরাসরি বিপরীত নয় এমন সব কিছু যেই করুক যেখান থেকেই আসুক যার মাধ্যমেই হোক সব কিছুই শরিয়ত সম্মত ও ইসলামের অর্ন্তগত। সব কল্যাণই সরাসরি বা সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের দান।

ইসলামের প্রকৃত দিকদর্শনে বিশ্বমানবতার সার্বিক কল্যাণে রাষ্ট্র অবশ্যই ধর্মীয় মানবিক মূল্যবোধের সার্বজনীন বিজ্ঞানসম্মত প্রগতিশীল দিকদর্শনে গড়ে উঠবে অনুসরণ করবে, কিন্তু রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই সরাসরি কোন ধর্মীয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র ও ধর্ম একাকার করে মিলিয়ে ফেলা উভয়ের জন্য ক্ষতিকর, অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতা।

ইসলাম এক অসীম বিশাল বিষয়। মানব জীবনে আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুল প্রদত্ত পূর্ণাংগ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এটা কোন রাষ্ট্রনির্ভর রাষ্ট্রআশ্রিত নিছক রাজনৈতিক মতবাদ নয়। এর মূল স্থান মানুষের আত্মা ও জীবন, রাষ্ট্র বা ভূমি নয়। অবশ্যই রাষ্ট্র, বিশ্ব ও জীবনের সব বিষয়ে সার্বজনীন নীতিমালা ও মহাদিকদর্শন। যে দিকদর্শনে রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের নাম লাগাতে হয় না, ধর্মরাষ্ট্র বা রাষ্ট্রধর্মও করতে হয় না। রাষ্ট্রীয় ভাবে শরিয়ত প্রয়োগের নামে দ্বীনের নীতি বিরোধী, স্বৈরাচারী বাড়াবাড়ি, নিপীড়ন, ব্যক্তি জীবনে হস্তক্ষেপ প্রভূত্ত্বের স্থান নেই, যে দিকদর্শণে সত্য সুবিচার মানবতা অধিকার ভিত্তিক সার্বজনীন সুব্যবস্থার সাধনা এবং মিথ্যা অবিচার জুলুম শোষণ ও যাবতীয় বস্তুবাদী স্বৈরশক্তি এবং স্বাধীনতা মানবতা বিরোধী অপশক্তি থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করাই প্রধান লক্ষ্য হয়। যার রাজনৈতিক দিকদর্শনের নাম খেলাফত বা প্রতিনিধিত্ব তথা দ্বীনী মূল্যবোধ ভিত্তিক সার্বজনীন গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিশ্বাস আদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবন সম্পদ যেখানে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত আমানত।

ঈমান কলেমার মূলনীতি ও দ্বীনের সার্বজনীন মানবিক আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করে স্বাধীনতা মানবতা হরণ করে এর বিপরীত বস্তবাদী গোত্রতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে মূলতঃ কলেমার অঙ্গীকার তাওহীদ রেছালাতভিত্তিক জীবনচেতনা উৎখাত, স্বাধীনতা অধিকার নস্যাৎ ও দ্বীনের সার্বিক দিকদর্শনকেই নির্মূল করার অপচেষ্টা শুরু করে আইয়ামে জাহেলিয়াতের বস্তুবাদী গোত্রবাদী অপশক্তি। গোত্রবাদের মাধ্যমে কলেমার চেতনা ও প্রকৃত দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে বিভক্ত ও অন্তর্কলহে লিপ্ত করে শক্তিহীন করে জাতীয় ঐক্য ও শক্তি বিনষ্ট ও দ্বীনের অগ্রযাত্রা বন্ধ করে দেয়ার অসৎ চক্রান্ত শুরু হয়। ঈমান দ্বীনের শত্রু খোদাদ্রোহী নবীদ্রোহী অভিশপ্ত বস্তুবাদী গোত্রবাদী কাফের এজীদের মাধ্যমে এ বিনাশী প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয় ঈমান দ্বীন খেলাফতের ধারক রক্ষক, মিল্লাতের প্রাণ প্রদীপ, দ্বীনের মহান ইমাম ইমামে আকবার রাদিআল্লাহু আনহুকে হত্যার মাধ্যমে।

মহান মকবুল সাহাবায়ে কেরামের অশেষ ত্যাগ পরিশ্রম শাহাদাতের বিনিময়ে বিশ্বমানবতার মুক্তি স্বাধীনতা ও বিকাশের পথ খেলাফত যারা উৎখাত করে দ্বীনের রূপরেখা ও গতি রূদ্ধ করেছে, কলেমার চেতনা নস্যাৎ করে বস্তুবাদী গোত্রবাদী স্বৈর দস্যুতা দুঃশাসন কায়েম করেছে তারা কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের ক্ষতি করেছে, সবার হক লংঘন করেছে। রাষ্ট্রীয় খেলাফত তাদের ব্যক্তিগত পারিবারিক বিষয় নয় যে অবৈধ পরিবর্তন করে পরিবারে বণ্টন করে দেবে। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিষয় এভাবে লুণ্ঠন শুধু কূফর নয়, চুরি ডাকাতি দস্যুতার চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ। ঈমানদার তো কোন ক্রমেই নয়, কোন সাধারণ সভ্য মানুষও এ ধরনের ভয়ংকর বিনাশী দুষ্কৃতি চিন্তাও করতে পারে না।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের জীবন বিধ্বংসী আঁধার বিভিষীকায়, ধর্মের নামে নানাবিধ অধর্মের কলুষ বর্বরতায়, বিশ্বমানবমণ্ডলী যখন সত্যকে হারিয়ে জীবনের সংজ্ঞা সহ ভূলে বিনাশের চরম স্তরে উপনীত হয়, বস্তুবাদী কলুষতায় হিংসা সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী আঁধার বিপর্যয় উম্মত্ত নিপীড়ন যখন অসহায় মানব জীবনকে পুরো গ্রাস করে ফেলেছিলো, তখন দয়াময় আল্লাহতায়ালার অসীম রহমত, উদ্ধারকর্তা ও মুক্তিদাতা হিসেবে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামের মহান শুভাগমন ঈদে আজমের মাধ্যমে সত্যের যে আলো, অস্তিত্ত্বের যে অবলম্বন, জীবনের যে দিশা, মুক্তির যে পথ পাথেয়, জ্ঞান বিজ্ঞান নিরাপত্তা বিকাশ প্রগতির যে দিকদর্শন বিশ্ববাসী লাভ করলো, মহান খোলাফায়ে রাশেদীন ও মকবুল ছাহাবায়ে কেরামের অশেষ ত্যাগ ও অক্লান্ত সাধনায়, বদর ওহোদ ও অনেক শাহাদাত মহাত্যাগের বিনিময়ে বস্তুবাদী আঁধার মিথ্যা অবিচার জুলুম শোষণ দূর হয়ে, সত্য সুবিচার মানবতা অধিকার ভিত্তিক যে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার মাধ্যমে মানব জীবন ও সভ্যতা মুক্ত ও বিকশিত হয়ে উঠতে শুরু করলো, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের মর্যাদা অধিকার ও মুক্ত জীবন নিশ্চিত করে দোজাহানে মুক্তির যে দ্বীন বিস্তার লাভ করেছিল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে, আইয়ামে জাহেলিয়াতের বস্তুবাদী গোত্রবাদী মানবতা বিধ্বংসী অপশক্তি মুসলিম ছদ্মবেশে তা বিনাশ করে বিশ্ব মানবতাকে পুনরায় অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করতে উদ্যত হলো। ইসলাম ও এর খেলাফতের দেয়া আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সকল স্বাধীনতা অধিকার হরন করে, কলেমা দ্বীনের সব নীতিমালা অস্বীকার করে, খেলাফত তথা দ্বীনী মূল্যবোধ ভিত্তিক সার্বজনীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করে সবাইকে বস্তুবাদী স্বৈর দাসত্বে আবদ্ধ করতে শুরু করলো, তখন সত্যের ইমাম মহান ইমামে আকবার ও তাঁর পবিত্র কাফেলা কারবালার ময়দানে এর প্রতিরোধে শাহাদাতের বিনিময়ে কলেমার অঙ্গীকার, তাওহীদ রেছালাত ভিত্তিক জীবন চেতনা ও সমগ্র মানবমণ্ডলীর স্বাধীনতা অধিকারের আদর্শ এবং দ্বীনে হকের পতাকা সমুন্নত রাখলেন, হক ও বাতেলের পরিচয় উম্মোচন করলেন, মিল্লাতকে রক্ষা করলেন।

মহান ইমামে আকবার রাদিআল্লাহু আনহুর এ অতুলনীয় মহান শাহাদাতের শিক্ষা ও আহবানের মধ্যেই রয়েছে কলেমার মর্ম কথা, দ্বীনের আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক সার্বিক রূপ, ঈমানী অস্তিত্ব ও ব্যক্তিগত এবং জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষাকবচ, সকল বিপর্যয় ও সব অপশক্তির কবল থেকে মুক্তির দিকদর্শন, দয়াময় আল্লাহতায়ালা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্ল্লামের জন্য হৃদয়ে পূর্ণ উৎসর্গীকৃত হওয়ার মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যে পৌছার শক্তি এবং সমগ্র মানবতার জন্য বস্তুবাদী বিনাশ ও তদভিত্তিক স্বৈরাচারী দাসত্ব থেকে মুক্তির নির্দেশনা।

সত্য স্বাধীনতা মানবতার পূর্বাপর ধারার সকল সংগ্রামের সকল শিক্ষা ও চেতনার সম্মিলিত রূপ কারবালার শাহাদাত এবং মিথ্যা অবিচারের পূর্বাপর সম্মিলিত চক্রের বিরুদ্ধে আদর্শিক বিদ্রোহের মুক্তি সংগ্রামের শাহাদাত কারবালার শাহাদাত। দ্বীনের পরিপূর্ণ শিক্ষা ও রূপের ধারক শাহাদাতের কারবালার এই চির উজ্জ্বল দিবসই মিল্লাতের অস্তিত্ত্বের স্মারক, পরবর্তী সবার জন্য সত্য-মিথ্যা শত্রু-মিত্রের চির নির্ণায়ক অলঙ্ঘনীয় অবলম্বন মহান জাতীয় শহীদ দিবস। এ দিবসের শিক্ষা চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম স্বত্ত্বা থাকে না। এ দিবসের লক্ষ্য আহবান নির্দেশনা ভূলে গেলে মিল্লাতের প্রকৃত কোন অস্তিত্ত্ব থাকে না। এ দিবস ও মুমিনের জীবন অবিচ্ছেদ্য। এ দিবস ও দ্বীন মিল্লাত একাকার।

দশই মহররম ইতিহাসের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ন ঘটনা থাকলেও কারবালার শাহাদাতের ঘটনাই আমাদের জন্য প্রত্যক্ষ কার্যকরী ঘটনা যেখানে সমগ্র মিল্লাত ও দ্বীন পূরোপূরী জড়িত। কারবালার শাহাদাতের দিবস থেকে জাতির ইতিহাস এ দিবস ব্যতীত হতে পারে না। কেবল আশুরা শব্দে যেমন শাহাদাতে কারবালার শিক্ষা চেতনা ত্যাগ মহিমা প্রকাশ পায় না, তেমনি শাহাদাতে কারবালার পূর্বের দশই মহররম ও পরের দশই মহররম কোন অবস্থাতে কোন মতেই এক নয়। শাহাদাতে কারবালার ঘটনা গৌণ করে অন্য সকল ঘটনা ইতিহাস ও ফজিলতের সব অলোচনা করলেও মিল্লাত এ দিবস থেকে কোন দিশা দিকদর্শন পাবে না। পক্ষান্তরে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে শাহাদাতে কারবালার ঘটনাকেই এই দিবসের মুখ্য ঘটনা ও শিক্ষা রূপে পালন করতে পারলে পূর্ব ইতিহাসের সব শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটবে। মিল্লাত ও মানবতাকে এজিদবাদ বস্তুবাদ ইসলামের ছদ্মনামে ধোকা দিতে পারবে না, প্রকৃত ইসলাম ও ইসলামের ছদ্মনামে কুফরী প্রতারণা কখনও একাকার হয়ে প্রকৃত ইসলাম বিলুপ্ত হবে না।

জাতীয় শহীদ দিবস শাহাদাতে কারবালাকে কেন্দ্র করে আদি অন্তের সকল শহীদানের স্মরণ দিবস, তাদের সকল ত্যাগ শিক্ষা ও আমাদের প্রতি তাদের সবার অসীম মেহেরবানীর স্মারক দিবস, তাঁদের সবার এক ও অভিন্ন প্রেম ও প্রেমাস্পদ এবং এক ও অভিন্ন লক্ষ্য উদ্দেশ্য চেতনার প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ একাত্ম হওয়ার শপথের দিবস। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর হাবীবের প্রতি পৃথিবীর শুরু থেকে সত্যের সকল শহীদের প্রেমের ধারা ইমামে আকবর ছৈয়দুশ শোহাদা ইমাম হোছাইন রাদিআল্লাহু আনহুর মধ্যে এসে মিলিত হয়েছে। অপরদিকে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ সকল কাফের জালেম খবিছ পাপাত্মা দুর্বৃত্তের সকল ধারা সকল পাষন্ডতা নরপশু ঘৃন্য এজিদ ও তার কদর্য কাফের দোসরদের মধ্যে মিলিত হয়েছে। ইমামে আকবর থেকে ইমামের শিক্ষা ও শাহাদাত থেকে সত্যান্বেষী মানুষ কেয়ামত পর্যন্ত আলোকিত সমৃদ্ধ হতে থাকবে আর অভিশপ্ত খবিছ জাহান্নামী এজিদ ও তার দোসরদের কেউ অনুসারী হলে চিরদিন কলূষিত অভিশপ্ত হয়ে সত্যের শত্রু হিসেবে জাহান্নামে যেতে থাকবে। পবিত্র আহলে বায়েত, মহান খোলাফায়ে রাশেদীন ও তাঁদের মহান উত্তরাধিকার মহান ইমামে আকবারকে ভালবাসা সত্য ও মানবতাকেই ভালবাসা, দয়াময় আল্লাহ ও মহান প্রিয়নবীকেই ভালবাসা, নিজের জীবনকে সত্যের ধারায় যুক্ত রাখা। কাফের এজিদ ও তার দোসরদের ঘৃণা মিথ্যা জুলুম স্বৈরতা দস্যুতাকেই ঘৃণা করা।

কারবালার চিরঅম্লান ঘটনার পর মুসলিম মিল্লাতের স্বপথ বিপথ শত্রু-মিত্র অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সমগ্র মিল্লাতের জন্য এ দিবস নিজের ইমামে হক ইমামে আকবারের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর হাবীবের দেয়া দোজাহানের নাজাতের পথ কিম্বা কাফের এজিদের পথে ফেরাউন নমরুদ আবু জেহেল আবু লাহাবের অভিশপ্ত পথ দোজাহানে বিনাশের পথ এ দু পথের এক পথ স্পষ্ট চিনে নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।

এ দিবসের চেতনাকে ধারন করে এর শিক্ষা ও লক্ষ্যের বাস্তবায়নে গৃহীত সঠিক কর্মসূচীতে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই বিশ্বব্যাপী মিল্লাতের মুক্তি ও পুনরুত্থান নিহিত, প্রকৃত দ্বীনের পুনরূজ্জীবন এবং সত্য ও মানবতার বিজয় নিহিত। দয়াময় মাআবুদ আল্লাহতায়ালা ও তাঁর সব রহমত নেয়ামতের নাজাতের উৎস প্রিয়নবীর হয়ে থাকতে হলে, সত্যকে নিয়ে বাঁচতে হলে, স্বাধীনতা অধিকার নিয়ে চলতে হলে, বাতেলের কবল থেকে জালেমের নিপীড়ন থেকে উদ্ধার হতে হলে, স্বৈরদাসত্ব থেকে মিল্লাতের মুক্তি আনতে হলে এ দিবসের শিক্ষা চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এ দিবসের পরিচয় ও এর শিক্ষার আলো ধরে রাখতে না পারার কারনে এজিদবাদ তথা খোদাদ্রোহী নবীদ্রোহী অপশক্তি দ্বীন বিকৃত করে কলেমার চেতনা নস্যাৎ করে আবার দ্বীনের লেবেলেই আইয়ামে জাহেলিয়াত কায়েম করেছে। এদের সহায়তায় সত্য সভ্যতা মানবতার শত্রুগন মিল্লাতের স্বাধীনতা হরন করে বিনা বাধায় ইচ্ছামত বিশ্বব্যাপী অকাতরে হত্যা অবরোধ নিপীড়ন আগ্রাসন বর্বরতা নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্য কোন তাৎপর্য্যহীন লক্ষ্যহীন নামে নয়, কোন কার্পণ্য নয়, মিল্লাতের একমাত্র জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবেই আমাদের আজ এ দিবস পালন করতে হবে কলেমার মর্ম ও দ্বীনের প্রকৃত রূপরেখা সমুন্নত রাখার জন্য এবং নিজেদের ও সমগ্র মানবতার মুক্তি স্বাধীনতা প্রগতির জন্য। ইলাহিয়াত রেছালাতের সম্বন্ধ ও আপনত্ব এবং মুমিনের হৃদয় জীবন ও এ দিবস এ শাহাদাত অবিচ্ছিন্ন। মহান ইমামে আকবার সত্যের জন্য নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেননি, করেছেন কেবল কলেমার শিক্ষা টিকে থাকার চিন্তা, প্রিয়নবীর দেয়া সে নূরের হীরক রশ্মি বিকীরনের চিন্তা, জীবনসত্যের পরিচয় ও মিল্লাতের ঈমানের নিরাপত্তার চিন্তা। নবীর উম্মতের জন্য মিল্লাতের জন্য মানবতার জন্য নিজের রক্ত মোবারাক বিলিয়ে দিয়েছেন, শাহাদাত কবুল করে নিয়েছেন। আদি অন্তের সর্বোচ্চ কোরবানী শাহাদাতের এ দিবস মিল্লাতের মহান শহীদ দিবস। এ শাহাদাত এ দিবসের শিক্ষা আদর্শ নির্দেশিকা ভূলিয়ে দিতে পারলে আত্মা নির্বাপিত করে দেয়া যাবে, কলেমা উচ্চারণ হবে কিন্তু কলেমার আলো সংযোগ চেতনা মর্ম থাকবে না। এ দিবসের শিক্ষা ভুলিয়ে দেয়ার মধ্যেই সমগ্র বাতেল জালেমের লাভ ও জয়, আমাদের ও আমাদের দ্বীনের পরাজয়, বিপর্যয়।

মিল্লাতের জাতীয় শহীদ দিবসের সার্থক পালনের জন্য সত্যের ধারকদের যেমন চিনতে হবে, সত্যের শত্রুদেরও অবশ্যই চিনতে হবে। এ যুগের এজিদবাদের বিভিন্ন মুখী চক্রজাল না বুঝলে এবং জাতীয় মুক্তির পূর্নাঙ্গ কর্মসূচীতে সংযুক্ত না থাকলে জাতীয় শহীদ পালন শাহাদাতে কারবালার মূল ধারার সাথে সম্পর্কহীন ও মূল্যহীন হয়ে দাঁড়াবে। অনেকে বিভিন্ন নামে এ দিবস পালন করেন। কেউ ভালোবাসায়, কেউ ব্যবসা হিসেবে, কেঊ প্রদর্শনী, কেউ অসৎ লক্ষ্যে বিকৃত উদ্দেশ্যে পালন করেন। ভালো মনে আন্তরিক ভাবেও অনেকেই পালন করেন, কিন্তু কিসের পক্ষে, কিসের বিরুদ্ধে, কি শিক্ষা, কি আমানত উত্তরাধিকার এ শাহাদাতের তা খবর রাখেন না বা বুঝতে চেষ্টা অনেকে করেন না। কোন সে খোদাদ্রোহী নবীদ্রোহী দ্বীনদ্রোহী অভিশপ্ত শয়তান যে আল্লাহ হাবীবের এ পরম প্রিয়তম আলো ও দ্বীন খেলাফতের ধারক ও রক্ষক মিল্লাতের এই নয়নমনিকে খুন পর্যন্ত করলো, কি তার উৎস ও উদ্দেশ্য, কি তার মতপথ ধারা, আজ এ যুগেও সে বিনাশী কুফরী ধারা কিভাবে কাদের মাধ্যমে সবার ক্ষতি করে যাচ্ছে, তা না বুঝতে পারলে কেবল অনুষ্ঠান ফলপ্রসূ হবে না বরং অপশক্তির ধোকায় নিমজ্জিত হয়ে অন্ধ হয়ে থাকতে হবে। ব্যক্তিজীবনেও কুফর মিথ্যা ও জুলুমের ধারা তথা ইসলামের ছদ্মবেশী বাতেল ফেরকা ও বস্তুবাদী মতবাদ থেকে মুক্ত না হয়ে মহান জাতীয় শহীদ দিবস বা শাহাদাতে কারবালা যে নামেই হোক লক্ষ্যবিহীন নিছক আনুষ্ঠানিক পালনের কোন সার্থকতা নেই। ঈমানের কলেমার সত্যের আলোকধারা ইলাহিয়াত রেছালাত ভিত্তিক জীবনসত্ত্বার পবিত্র পথে এর বিপরীত মত পথ থেকে আপোষহীন পবিত্র থেকে দ্বীনের পূর্নাংগ ধারায় সমগ্র মানবতার মুক্তি সাধনায় কার্যকর ভাবে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে চলার মধ্যেই এ দিবস পালনের সার্থকতা।

দুনিয়া ব্যাপী আজ ইসলাম, মুসলিম মিল্লাত এবং সভ্যতা মানবতার এক মারাত্মক সংকট ও চরম ক্রান্তিকাল সংঘটিত হচ্ছে। সত্য ও মানবতার শক্তি দুর্বল অক্ষম বিভক্ত পথহারা বিভ্রান্ত করে রাখায় সকল প্রকার অপশক্তি চরম তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে। দ্বীনের প্রকৃত ধারা সত্য ও মানবতার ধারা অতীতে যথার্থ বিশ্ব পরিকল্পনায় ও কর্মসূচীতে অগ্রসর না হতে পারায় এবং একের পর এক মারাত্মক ঐতিহাসিক ভুল সিন্ধান্তের কারনে সমগ্র দুনিয়া অপশক্তির কব্জায় চলে গেছে। আরও দুঃখজনক যে, দ্বীনের আসল ধারা ছুন্নী ভাইদের মাদ্রাসা খানেকা দরবার গুলো থেকেও সঠিক ও পূর্নাঙ্গ দিশা আসছেনা, এমন কি অনেকে আহলে ছুন্নাতের পবিত্র নামে নানাবিধ ভ্রান্ত দল মতের স্বার্থে বুঝে বা না বুঝে ব্যবহার হচ্ছেন, ব্যবহার করছেন। এ পবিত্র নামেও অজ্ঞতা কিম্বা ধোকা প্রতারনা ও স্বার্থসিদ্ধি সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, যেন আমাদের জীবন, আবেগ, উৎসর্গ ও জীবনের একটা মুহুর্তও ভ্রান্ত পথে কিংবা কারো অসৎ স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয়।

একদিকে সত্য স্বাধীনতা মানবতার মুক্তিসূর্যের উদয়স্থল দ্বীনের কেন্দ্রভূমি কেবলাভূমিতে হুবুহু এজিদবাদের ধারায় কলেমা দ্বীন পরিপন্থী বস্তুবাদী গোত্রবাদী ওহাবীবাদী স্বৈরতন্ত্র সব আঁধার বিপর্যয়ের উৎস হিসেবে কাজ করছে। দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামী দলের নামে, ইসলামী রাষ্ট্রের নামে, শরিয়তী শাসন, কোরআনী আইন ইত্যাদি শব্দে ঈমান ইসলামের প্রকৃত ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত পথভ্রষ্ট, ঈমান দ্বীন শরিয়ত তরিকতের সম্পূর্ণ বিপরীত প্রাচীন বাতেল খারেজী রাফেজী সালাফী এজিদবাদী দুর্বৃত্তদের প্রচন্ড প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যারা ঈমানের মৌলিক বিষয় শানে রেছালাতের সিফাত মহিমা অস্বীকার, ইসলামের আসল শিক্ষার অস্বীকার ও বিকৃতি ঘটিয়ে কোরআনুলকরীম ও হাদীছ শরীফের মারাত্মক অপব্যাখ্যা, দ্বীনের প্রাণপ্রবাহ আওলিয়াকেরামের মাজারশরীফ ভেঙ্গে ওরশ শরীফে হামলা, মুসলিম অমুসলিম সব রকমের নিরাপরাধ মানুষকে পবিত্র জিহাদের বিকৃতি ঘটিয়ে খুন অপহরণ সন্ত্রাস চালাচ্ছে। সরল প্রাণ যুব সমাজকে জিহাদের নামে জংগী বোমাবাজ অপ্রকৃতিস্থ করে তাদের জীবন ও পরিবার বিপন্ন করে অপরাধী করে তুলছে, সম্মোহিত করে হিজরতের নামে ঘর সংসার থেকে বের করে বিকৃত বিপন্ন করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বলি দিচ্ছে, আর সব অপরাধ করে চলেছে ইসলামের পবিত্র নামে। বোনদের শিক্ষা নিষিদ্ধ ও অধিকার স্বাধীনতা মর্যাদা হরণ করে, শরিয়ত সম্মত স্বাভাবিক পোশাকের পরিবর্তে পর্দার নামে মনগড়া অতিপর্দার বিকৃত অবরোধ আরোপ করে মিল্লাতকে পঙ্গু করে তুলছে।

দ্বীনের প্রকৃত ধারা থেকে বহির্ভূত ও দ্বীন বিকৃতিকারী বাতেল হিংস্র সন্ত্রাসী শিয়াবাদও আমাদের মহান ইমামদের পবিত্র নামে ধোকা দিয়ে এবং হীনস্বার্থে মর্মান্তিক দশই মহররমের অপব্যবহার করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে চলছে। তবলীগ জামাতের নামে জঘন্য ওহাবী মতবাদ ডুকাচ্ছে এবং ঘর পরিবারের ফরজ দায়িত্ব থেকে বের করে দ্বীন নিষিদ্ধ বৈরাগ্য প্রবর্তন, জীবন ও পরিবার ধ্বংস করে দিচ্ছে। ঈমান ও দ্বীনের সুস্থ স্বাভাবিক সুন্দর রূপরেখা বাদ দিয়ে কতিপয় আইন আমল ফতোয়া পোশাক ইত্যাদি বাহ্যিক গৌণ বিষয় গুলোকেই মূল মহা বিষয় দেখিয়ে প্রকৃত দ্বীন বিকৃত ও বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। ঈমান পরিপন্থী বাতেল সালাফী লামজহাবী ও ওহাবী মতবাদ থেকে উদ্ভুত মওদুদীবাদ ও আরও কয়েকটি পথভ্রষ্ট বিকৃত মৌলবাদী দল অনেককে ইসলামি দল হিসেবে বিভ্রান্ত করে দলে ভিড়িয়ে উগ্র বিকৃত পথে ঠেলে দিচ্ছে। যুব সমাজের একটা অংশের ইসলামের প্রতি ভালবাসার অপব্যবহারের মাধ্যমে অপব্যাখ্যা ও ধোকা দিয়ে প্রকৃত ইসলামের বিপক্ষে বিনাশে তাদের বিকৃত মতবাদ কায়েমে ব্যবহার করছে। কওমী মাদ্রাসার নামে খারেজী ওহাবী আখড়াগুলো আলেমের বেশধারী ওহাবীবাদী এজিদবাদী ঈমানহরণকারী উগ্র সন্ত্রাসি ও প্রকৃত দ্বীনের শত্রু তৈরি করছে, যারা মহান ঈদে আজম সালাতু সালাম পর্যন্ত বাধা দেয়ার ধৃষ্টতা করে। দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা ও মর্ম উৎখাত করে প্রদর্শনী হিসেবে কতিপয় আইন ফতোয়ার সীমা লংঘন বাড়াবাড়ি অপপ্রয়োগ করে এরা দ্বীন মিল্লাতের সীমাহীন ক্ষতি করে যাচ্ছে। মুসলিম ছদ্মবেশি ইসলামের নামধারী এইসব এজিদবাদি বাতেল ফেরকা আজ ঈমান দ্বীন মিল্লাতের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাদের অপকর্মের কারনে প্রকৃত দ্বীন মিল্লাত ভিতর থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং অন্যান্য অপশক্তি তাদেরই কারণ ও সহায়তায় ভয়ঙ্কর বিনাশী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে ফিলিস্তিন, আরাকান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, মালি সহ আর অনেক স্থানে সভ্যতা মানবতার শত্রুগণ নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বর্বর অত্যাচার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, নিরাপরাধ শিশু মহিলা সহ অসংখ্য মানুষ খুন হচ্ছে, চরম আতঙ্ক ও মারাত্মক সংকটে চরম বিপর্যস্ত শোকার্ত জীবন নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সত্য ও মানবতার শক্তির দ্রুত বিশ্বশক্তি হিসেবে উত্থান না হলে এ অবস্থা দিন দিন ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর বিনাশী সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে, যা থেকে কেউ নিস্তার পাবে না।

কিন্তু এখনও দুনিয়ায় বিবেকবান ভালো মানুষের সংখ্যা অধিক, তবে অসংগঠিত অনৈক্যবদ্ধ ও নিষ্ক্রিয়। সত্য, মানবতা ও শান্তির পক্ষে, হত্যা, বর্বরতা, উগ্রতা, আগ্রাসন, নৃশংসতা অপরাধের বিরুদ্ধে ধর্ম পথ নির্বিশেষে আমরা যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ হই, সক্রিয় হই, সুনিশ্চিত ভাবে দুনিয়ায় পরিবর্তন আসবে, শুভশক্তির মহা উত্থান হয়ে অশুভ শক্তি অকার্যকর হবে এবং দুনিয়ায় শান্তি মানবতা নিরাপত্তা ও প্রগতি নিশ্চিত হবে। প্রিয়নবীর আলো মহান ইমামে আকবারের ভালোবাসা ও উত্তরাধিকর দাবি করতে হলে শুধু নিজের নয় সবার চিন্তা করতে হবে এবং আমাদেরকে বিপন্ন দ্বীন ও আর্ত মানবতার পাশে দাঁড়াতে হবে। অবিলম্বে এ অভিযাত্রা শুরু করতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে, নতুবা দ্বীনের নামে বেনামে সকল প্রকার এজিদবাদ এক পক্ষীয় শক্তি হিসেবে ব্যাপকতর হয়ে সবাইকে সব কিছুকে গ্রাস করে নিবে।

তাই আসুন আমরা জীবনের সব কিছু ঠিক রেখে নিজেকে কেবল ব্যক্তি জীবনে আবদ্ধ না রেখে মুক্তির মহান দ্বীন ও বিশ্ব মানবতার জন্যও একটু চিন্তা করি, বিবেককে জাগ্রত করি এবং যুগের সঠিক কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ ও শরিক হই।

মূল প্রবন্ধঃ ইমাম হায়াত আলাইহে রাহমা
সংকলনেঃ অধ্যাপক আল্লামা ডঃ কাওছারুল আমীন রাছেখ
(প্রাক্তন অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ)
ইসলামি গবেষক ও কেন্দ্রীয় নেতা, ছুন্নী আন্দোলন, বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment