Sunday 16 February 2014

রাসূলুল্লাহ (s.) -এর রওদ্বা শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর

বুখারী শরীফের হাদীস
لا تشد الرحال الا الى ثلاثة مساجد
এর উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়া ও তার অনুসারীরা কবর যিয়ারত এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওদ্বা শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে হারাম বলেন। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা ও উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার কিতাবে বলেন,

আমার নিকট এর সুন্দর জবাব হলো হাদীসখানা কবর সংক্রান্ত মাসয়ালা বর্ণনার উদ্দেশ্যে বর্ণিত হয়নি। যেমন মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে:-

‘তোমরা নামায পড়ার জন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করবে না, তিনটি মসজিদ ছাড়া।’ সুতরাং হাদীসটি এদিকেই নির্দেশ করে যে, কেবলমাত্র মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ। কবর যিয়ারতের মাসআলার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই (ফয়যুল বারী, ২য় খন্ড, ৪৩৩ পৃষ্ঠা)।

বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফতহুল বারী গ্রন্থে ইবনে হাজার আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:-

“কিরমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের সময়ে শাম দেশে এ বিষয়ে (কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর) অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, উভয় পক্ষে অনেক পুস্তিকা রচিত হয়েছে। আমি (ইবনে হাজার আসকালানী) বলি, কিরমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইঙ্গিত হলো, শায়খ তকীউদ্দিন আসসুবুকী ও অন্যান্যদের দিকে যারা ইবনে তাইমিয়া ও তার সহযোগী হাফিয শামসুদ্দীন ইবনে আবদুল হাদীসহ অন্যান্যদের বিরোধীতা করেছেন। এটি আমাদের অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ঘটনা।

সারকথা হলো তারা বলেন, ইবনে তাইমিয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওদ্বা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে হারাম বলেন। আর আমরা তা অস্বীকার করি। এ বিষয়ে উভয়পরে বর্ণনা অনেক দীর্ঘ। এটি ইবনে তাইমিয়া থেকে বর্ণিত অপ্রিয় মাসয়ালাগুলোর অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরীফ যিয়ারত করা ইজমার ভিত্তিতে বৈধ।

এ বিষয়টি প্রত্যাখান করতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়া ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিম্ন বর্ণিত বর্ণনা পেশ করেন,

‘ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একথা বলতে অপছন্দ করতেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর যিয়ারত করেছি।"

অথচ মালিকী মাযহাবের ফকীহগণ এর উত্তর দিয়েছেন যে, ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শিষ্টাচারবশত এ শব্দ ব্যবহার করাকে অপছন্দ করতেন, যিয়ারত করাকে অপছন্দ করতেন না। কেননা এটি একটি উৎকৃষ্টতম আমল এবং আল্লাহ তা’আলার নিকটে পৌঁছার বড় মাধ্যম।
এতদসত্ত্বেও যিয়ারতের বিষয়টি বিতর্ক ছাড়া ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। কোন কোন মুহাক্কিক বলেন, হাদীসে বর্ণিত শব্দ এর মুসতাসনা মিনহু বা তার পূর্বের অংশ উহ্য রয়েছে, আর উহ্য অংশটি হয়তবা ‘আম’ বা ব্যাপক অথবা ‘খাছ’ বা সুনির্ধারিত। যদি ব্যাপক হয় তখন তার অর্থ হবে, এ তিন স্থান ব্যতীত কোন স্থানেই যে কোন কাজের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না। আর এ ব্যাখ্যা বাতিল। কেননা এর মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য, আত্মীয়তার বন্ধন রা করা, জ্ঞানার্জন ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে সফর করাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কাজেই এখানে সুনির্ধারিত বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে সফর নিষিদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে উত্তম হলো যেটি সবচাইতে যুক্তিসঙ্গত সেটিকেই উহ্য ধরে নেয়া। আর তাহলো, তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না।

সুতরাং এর দ্বারা ঐসকল লোকদের বক্তব্য বাতিল, যারা বলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওদ্বা যিয়ারত ও সৎকর্মশীল বা আউলিয়ায়ে কিরামগণের মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষিদ্ধ” (ফতহুল বারী)।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসখানার ব্যাখ্যায় বলেন,

আমাদের শায়খ যায়নুদ্দীন বলেন, এ হাদীসের সুন্দরতম ব্যাখ্যা হলো, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মসজিদ। সুতরাং এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না। আর মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে সফর করা, যেমন- জ্ঞানার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিশুদ্ধতা লাভ, সৎকর্মশীলদের যিয়ারত ও তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ পরিদর্শন, ভাই-বিরাদরের সাাৎসহ অন্যান্য উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয় (উমদাতুল কারী, ২য় খন্ড)।

প্রিয় পাঠক! লক্ষনীয় বিষয় হলো বুখারী শরীফের জগদ্বিখ্যাত দুই ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারী ও উমদাতুল কারীর মুছান্নিফদ্বয়ের কেউই কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর নিষিদ্ধ বলেন নি।
হাফিয ইবনে তাইমিয়া যে কেবলমাত্র কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে হারাম বলেছেন তা নয়। এছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

★ দেওবন্দী আলিম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী তার ‘তাসাওউফ কী হাকীকত আর উস কে মাসাইল’ গ্রন্থে ইবনে তাইমিয়ার বিভ্রান্তিমূলক কতিপয় মাসআলার বর্ণনা দিয়েছেন যা নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

ইবনে তাইমিয়ার (৬৬১-৭২৮ হি.) কতিপয় ধর্মীয় ও আকীদাগত ধারণা :-

★ইবনে তাইমিয়া নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওদ্বা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে নাজায়িয মনে করেন। অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের উলামায়ে কিরাম ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওদ্বা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ বলেছেন।

* উলামায়ে কিরাম নির্ভরযোগ্য হাদীস بحق السائلين عليك -এর ভিত্তিতে ‘অমুকের সম্মানে’, ‘অমুকের কল্যাণে’, ‘অমুকের খাতিরে’ ইত্যাদি ওসীলা বা মাধ্যম অবলম্বন করার দ্বারা দু‘আ করাকে জায়িয বলেন। অথচ ইবনে তাইমিয়া একে নাজায়িয বলেন।

* ইবনে তাইমিয়া বেনামাযীকে যাকাত দেয়া নাজায়িয মনে করেন।

* حلف بالطلاق
(কসম করার সময়ে তালাকের শর্ত করা) এর khetre ইবনে তাইমিয়া ইমাম চতুষ্টয় ও অন্যান্যদের বিপরীত ফতোয়া দিয়েছেন এবং একে জায়িয বলেছেন।
* ইবনে তাইমিয়ার অভিমত অনুযায়ী নারীদের হায়যের সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন কোন সময়সীমা নেই। দুই হায়যের মধ্যবর্তী তুহুর বা পবিত্রাবস্থারও কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। অনুরূপভাবে বৃদ্ধা মহিলাদের হায়য বন্ধ হওয়ারও কোন সময়সীমা নেই বরং মহিলাদের অভ্যাসই যথেষ্ট।

* কসর নামায ছোট বড় সকল সফরেই পড়া যায়। অর্থাৎ ফরসখ বা মাইল বা এ জাতীয় কোন বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা এতে নেই। গৃহ থেকে বাজারে গমন বা দুই তিন ক্রোশ দূরে গমন করলেই কসর নামায পড়া যায়।

* ইবনে তাইমিয়ার মতে সিজদায়ে তিলাওয়াত আদায় করার জন্য তাহারাত বা অযূ করার প্রয়োজন নেই। অথচ চার ইমামসহ অন্যান্য উলামার মতে অযূ করা বশ্যক।

* আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (৯০৯-৯৭৪ হি.) স্বীয় الفتاوى الحديثية গ্রন্থে সে সময়ের কয়েকজন বুযুর্গ ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা করেন, তারা ইবনে তাইমিয়াকে একটি পাহাড়ী মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন যে, لسيدنا عمر غلطات অর্থাৎ হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অনেক ভুল করেছেন।

এরূপ দু চারটি নয় বরং প্রায় বিশটি মাস‘আলার েেত্র ইবনে তাইমিয়া না কোন মুজতাহিদ বা ইমামের তাকলীদ বা অনুসরণ করেন, না তিনি مجتهد منتسب বা কোন মুজতাহিদের মূলনীতি অনুসরণ করে মাস‘আলা চয়নকারী ছিলেন। অনন্তর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রতি তার প্রকাশ্য অবিশ্বস্থতা ছিল। সুতরাং চার মাযহাবের ইমাম ও বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিসীনে কিরামের বিপে তাঁর কোন অভিমত বিবেকবান মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদিও একদলের পক্ষ থেকে তাকে মকবুল বা গ্রহণযোগ্য, ইমামে আহলে সুন্নাত ও মুজতাহিদ উপাধিতে ভূষিত করা হয় (যেমন সালফী বা লামাযহাবীগণ অনুরূপ উপাধিতে ভূষিত করে.....

No comments:

Post a Comment